Home » ১৯৪৭ এর দেশভাগ ও খুলনা জেলার পাকিস্তানভুক্তি ইতিহাস

১৯৪৭ এর দেশভাগ ও খুলনা জেলার পাকিস্তানভুক্তি ইতিহাস

কর্তৃক Mahabobul Haque Polen
নিজস্ব প্রতিবেদক 124 ভিউ
Print Friendly, PDF & Email

এসএম মকিদঃ
১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভারতের বড়লাট মাউন্টবেটেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সম্মতিতে ভারতভাগ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে দেশভাগের একটি ঘোষণা প্রদান করেন। ঐ ঘোষণায় খুলনা জেলাকে সামান্য হিন্দুপ্রধান হিসেবে ভারতভুক্তি দেখানো হয়। তবে খুলনার বিষয়টা বাউন্ডারি কমিশনের বিচার্য বিষয় বলে বিবেচণার যোগ্য হওয়ার কথাও ঘোষণায় উল্লেখ থাকে।
৩ জুন লর্ড মাউন্টবেটেনের ঘোষণায় খুলনার মুসলমান সমাজ খুবই

উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। খুলনার সর্বদলীয় ব্যক্তিবর্গসহ মুসলিম সরকারি কর্মচারী একজোট হয়ে খুলনাকে পাকিস্তানভুক্তির জন্য বাউন্ডারি কমিটি নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন। ঐ কমিটির সভাপতি আব্দুল হালিম চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট এএফএম আব্দুল জলিলকে সম্পাদক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন এসএমএ মজিদ আবদুস সবুর খান সৈয়দ মোস্তাগাউসুল হক, এএইচ দিলদার আহমেদ,আবদুল হামিদ,সরদার নকিবুদ্দিন,এএইচএম আলী হাফিজ,সৈয়দ তোফাজ্জল হোসেন,কাজী তোজাম্মল আলী,হেমায়েত উদ্দিন,ডাঃ মোজাম্মেল হোসেন,আবু মুহম্মদ ফেরদৌস প্রমূখ। বাউন্ডারি কমিশনে স্মারকলিপি পেশ করার জন্য গঠিত সাবকমিটির উপর দায়িত্ব দেয়া হয়। ঐ কমিটির সেক্রেটারি আব্দুল জলিল ১ সপ্তাহব্যপী ২৬ পৃষ্ঠা দীর্ঘ স্মারকলিপি লেখেন।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে কলকাতার বেলভেডিয়ার হাউজে বাউন্ডারি কমিশন সমীপে স্মারকলিপি দাখিল করা হলো। যথাসময়ে হাউজের দ্বিতীয়তলায় প্রকান্ড হলঘরে র‌্যাডক্লিপ কমিশনের আদালত বসলো। ভারতের পক্ষে বিচারপতি নিযুক্ত হলেন বিজন মুখার্জি ও চারুচন্দ্র বিশ্বাস। পাকিস্তানের পক্ষে নিযুক্ত হলেন বিচারপতি এএসএম আকরম ও বিচারপতি এসএ রহমান।
কংগ্রেস মুসলিমলীগ হিন্দু মহাসভার পক্ষে সব প্রখ্যাত আইনজীবিরা নিযুক্ত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় মুসলিমলীগের আইনজীবি উত্তরপ্রদেশের অ্যাডভোকেট জেনারেল মুহম্মদ ওয়াসিম। প্রাদেশিক মুসলিমলীগ নিয়োগ করেন হামিদুল হক চৌধুরীকে। খুলনা ও ২৪ পরগণা জনতার পক্ষে নিযুক্ত হলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। অপরদিকে কংগ্রেস নিযুক্ত অতুলগুপ্ত এবং মহাসভার আইনজীবি এনসি চ্যাটার্জিকে। এছাড়া আরো অনেক আইনজীবি এই আন্তর্জাতিক মামলায় অংশ নেন।
ঐতিহাসিক আবদুল জলিল তাঁর “আমার দেখা আইন আদালত” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সেইসময়ে প্রধান আইনজীবিদের যেভাবে সুক্ষ্মসূত্রে মামলার কাগজপত্র বুঝিয়ে দিতে হয় আমরা তার বিন্দুমাত্র ত্রুটি করিনি। রাতদিন আইনজীবি ও নেতৃবৃন্দের দুয়ারে ঘুরে বেড়াতে হতো। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, আমি ও দিলদার আহমদ কমিশনের বৈঠক চলাকালীন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কোলকাতায় অবস্থান করি। কেউকেউ পরামর্শ দিতেন রূপসা ও ভৈরব নদীকে বাউন্ডারি লাইন করতে। আমরা এ জিলার সূচাগ্র পরিমাণ ভূমি ছাড়তে নারাজ। এই মর্মে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
‘শতাব্দির সাক্ষী’ গ্রন্থের প্রণেতা এএইচ দেলদার আহমদ তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, বাউন্ডারি কমিশনের শুনানীকালে খুলনার তৎকালীন এমএলএ মি.সবুর শুনানীতে যোগ না দেয়ায় খুলনার তৎকালীন ছাত্রসমাজের নেতা মি. ফেরদৌস সহ অন্যান্যরা তাঁর প্রতি মনক্ষুন্ন হন। আবু মুহম্মদ ফেরদৌসের কাছে আরো জানাযায়, বাউন্ডারি কমিটি গঠিত হয় বাবুখান রোড ও সামসুর রহমান রোডের সংযোগ স্থলে ‘রায় সাহেব কুঠিতে’ উকিল আব্দুল হক চৌধুরীর বাসায় এক মিটিংয়ে। সভায় আব্দুস সবুর সাহেব সেদিন উপস্থিত ছিলেন না। তাঁরমতে এসবের পিছনে বেশী অবদান ছিলো এসএমএ মজিদের। তিনি কো-অর্ডিনেটরের ভুমিকা পালন করেন। তিনি ছাত্র জনতা সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তা সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। খুলনা কলকাতা যাতায়াত কলকাতায় অবস্থানের যাবতীয় খরচা জনসাধারণের কাছ থেকে সংগ্রহ করে যথাস্থানে পৌঁছে দিতেন। মেমোরেন্ডামটি লিখেছিলেন বাউন্ডারি কমিটির সেক্রেটারি আব্দুল জলিল সাহেব। তাঁকে সহযোগিতা করতেন মজিদ সাহেবের সহপাঠী আত্মীয় ফুড কন্ট্রোলার সৈয়দ আব্দুল হালিম।

বেলভেডিয়ায় র‌্যাডক্লিপ কমিশন আদালতে প্রথমদিনে সওয়াল জওয়াব দিয়ে শুরু করেন কংগ্রেস মনোনীত আইনজীবী অতুলগুপ্ত। কয়েকদিন ধরে তার দীর্ঘতম যুক্তি পেশের পর সওয়াল জওয়াব পেশ করেন হিন্দুমহাসভার পক্ষে এনসি চ্যাটার্জী। তাঁর সমাপ্তিতে মুসলীম লীগের পক্ষে যুক্তি পেশ করেন মুহম্মদ ওয়াসীম। বাংলার হাল হকিকতের সংগে পরিচিত না থাকায় তিনি বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারলেন না। অতঃপর হামিদুল হক চৌধুরী পাকিস্তানের পক্ষে দীর্ঘসময় ধরে যুক্তি পেশ করে তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। এরপর সওয়াল জওয়াব শুরু করেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। আদালতে তাঁর উপস্থিতি ইতিমধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তিনি প্রথমে কলকাতা ও বসিরহাট পাকিস্তানভুক্তির দাবী করেন। খুলনার জন্য তাঁর দরদ ছিলো অপরিসীম। তিনি আরম্ভ করলেন খুলনা জিলা নিয়ে। সাগর বিধৌত সুন্দরবন বেষ্টিত,বরিশাল যশোর সংলগ্ন খুলনা জেলার নাড়িনক্ষত্র তাঁর নখাগ্রে। তিনি সব বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণী দিয়ে মাউন্ট ব্যাটেনের ঘোষণার সারবত্তা বিচারপতিদের বুঝিয়ে দেন। তাঁর যুক্তিতে খুলনাবাসি হলেন আশ্বস্ত,শ্রোতাবৃন্দ হলেন মুগ্ধ,বিচারপতিগণ গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলেন।
আগস্ট মাসের প্রথম দিকেই পাকিস্তান ভারত দু’পক্ষের শুনানী শেষ হলো। খুলনা জেলার ব্যাপারে ৪ জন জজ একমত হয়ে পাকিস্তানভুক্তির রায় দিয়েছিলেন। এরপর র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ ঘোষিত হলো। সমগ্র মুর্শিদাবাদ জেলা, নদীয়া, মালদহ ও দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ ভারতভুক্ত হলো। জলপাইগুড়ির ৪টি থানা পূর্ববাংলার সঙ্গে যুক্ত হলো। যশোর থেকে বেরিয়ে গেলো বনগাঁ ও গাইঘাটা থানা। সিলেট গণভোটে পাকিস্তানে যোগ দিলো। এ বিজয় সত্বেও করিমগঞ্জ রেলওয়ে জংশনসহ ৪টি থানা কেটে আসাম প্রদেশভুক্ত করা হলো।
খুলনার মুসলিম জনসাধারন ১৮ আগস্ট ঈদের দিন ভোরবেলা বেতার মারফত খবর পেলো সমগ্র খুলনা জিলা পাকিস্তানে এসেছে, তাদের আনন্দের সীমা রইল না।



রিলেটেড পোস্ট

মতামত দিন


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.