মাহবুবুল হক পোলেন
মেহেরপুরÑমুক্তিযুদ্ধের প্রথম অস্থায়ী সরকারের শপথভূমি, এক সময়ের সাহিত্য-সংস্কৃতির উর্বর ক্ষেত্র। সেই মেহেরপুরেই আজ বই যেন নির্বাসিত। হাতে স্মার্টফোন, চোখে নীল আলো, মাথায় তুচ্ছ আনন্দÑকিন্তু বইয়ের ঘ্রাণ নেই, নেই শব্দের জগতে ডুবে থাকার উন্মাদনা। ফলে সমাজটি দাঁড়িয়ে আছে খোলা চোখে অন্ধ হয়ে; আলো আছে, কিন্তু দেখার দৃষ্টি নেই। কিন্তু মেহেরপুরে মানুষ একসময় রবি ঠাকুর থেকে শরৎচন্দ্র, হুমায়ূন থেকে সমকালীন সাহিত্যÑসবই গিলে খেত। এখন বইয়ের নাম জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে: “সময় কোথায়?” মেহেরপুরে নতুন বই পড়া যেন বিলাসিতা, আর বই কিনে পড়াÑতারচেয়েও দু:সাহসিক কাজ। জেলা শহরের লাইব্রেরিগুলো যেন ধ্বংসাবশেষÑচেয়ার-টেবিল আছে, পাঠক নেই। স্কুল-কলেজে পাঠাগার আছে নামমাত্র; ধুলো জমে থাকে, কিন্তু বই খোলে না। যে বয়সে বই হাতে নিয়ে স্বপ্ন জাগার কথা, সে বয়সে শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে স্ক্রিনের রঙিন গোলকধাঁধায়। বইয়ের দোকানগুলো টিকে আছে শুধু নোটবুক আর কোচিং গাইডের ভরসায়। নতুন বই কিনে পড়া যেন এখনকার তরুণদের কাছে অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা, যেন বই মূল্যহীনÑএ ভাবনাই সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। কিন্তু বইহীন সমাজ মানে অচিন্তনশীল সমাজ। পাঠ না থাকলে যুক্তি জন্মায় না; যুক্তিহীন সমাজ সহজেই ভ্রান্তি, গুজব, বিভাজন আর উগ্রতার খাদে পড়ে। বইয়ের আলো মানুষকে মানুষ করে, নাগরিক করে, সচেতন করে। আর বইবিমুখ সমাজ সময়ের স্রোতে ভাসেÑকিন্তু দিক হারায়। বইহীন সমাজ মানে প্রশ্নহীন সমাজ, যুক্তিহীন সমাজ। আর প্রশ্নহীন সমাজেই ভ্রান্তি সবচেয়ে সহজে জেঁকে বসে। বই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় তোলে; কিন্তু বইহীন মেহেরপুর যেন নিজের অন্ধকারকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। মেহেরপুর কি তবে এমনই একটি সমাজে পরিণত হবে? নাকি আবার জ্বলে উঠবে পাঠের প্রদীপ? মেহেরপুরের মানুষ যদি বইকে আবার হাতের কাছে, হৃদয়ের কাছে ফিরিয়ে আনতে পারেÑতবে অন্ধকার কাটবে, দৃষ্টি ফিরে আসবে। বইয়ের আলোয় মেহেরপুর আবার জেগে উঠতে পারেÑযদি চাই, যদি উদ্যোগ নিই, যদি পাঠের আগুন আবার জ্বালাতে পারি আমরা। মেহেরপুরের মানুষ চাইলে আবারও বইকে হাতের কাছে ফিরিয়ে আনতে পারে। বই ফিরলে আলো ফিরবে, আলো ফিরলে বোধ জাগবে। ( ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, আমাদের সূর্যোদয়)

