Home » আজ ৬ ডিসেম্বর, মেহেরপুর মুক্ত দিবস

আজ ৬ ডিসেম্বর, মেহেরপুর মুক্ত দিবস

কর্তৃক Mahabobul Haque Polen
নিজস্ব প্রতিবেদক 33 ভিউ
Print Friendly, PDF & Email

স্বাধীনতার সূতিকাগার, বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরখ্যাত মেহেরপুরের আজ ঐতিহাসিক মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হয় সাহস-ত্যাগ-গৌরবে ভরা মেহেরপুর জেলা। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অসংখ্য ত্যাগ ও গেরিলা আক্রমণের মুখে পথ হারানো পাক বাহিনীর শেষ দলটি ৫ ডিসেম্বর বিকেল থেকেই গোপনে মেহেরপুর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। পরের দিন ৬ ডিসেম্বর প্রভাতের আলো ফুটতেই স্পষ্ট হয়—মেহেরপুর সম্পূর্ণ হানাদারমুক্ত।

এর আগে ২ ডিসেম্বর জেলার গাংনী উপজেলা পাক হানাদারদের দখলমুক্ত হলে শিকারপুরে (ভারত) অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর অ্যাকশন ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) তৌফিক ইলাহী চৌধুরী হাটবোয়ালিয়ায় এসে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করেন। ধারাবাহিক প্রতিরোধ ও পরিকল্পিত অভিযানে মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী ৫ ডিসেম্বর মেহেরপুর এলাকায় প্রবেশ করে। সীমান্ত জুড়ে পাক সেনাদের পাতা অসংখ্য মাইন অপসারণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে অগ্রসর হন। শেষ পর্যন্ত ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুর পুরোপুরি মুক্ত হয় হানাদারদের কবল থেকে।

মুক্তি পাওয়ার সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি স্মরণ করে এখনো গর্বে কাঁপে মেহেরপুরের মানুষ। পাক সেনারা পালিয়ে যাওয়ার পর সেদিন শহরের রাস্তায় নেমে আসে হাজারো মুক্তিকামী মানুষ। লাল-সবুজের পতাকা ওড়াতে ও বিজয়ের স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো শহর। ছাত্র-জনতা, আনসার-মুজাহিদ ও নানান পেশার মানুষের সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনীর গর্বমাখা পদচারণায় সেদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় স্বাধীনতার বীজতলা মুজিবনগর।

মেজর (অব.) ও তৎকালীন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ পাতান সেই স্মৃতি মনে করে বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রথম সরকার শপথ গ্রহণের পর চূড়ান্তভাবে মেহেরপুর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় হানাদার বাহিনীর কাছে। পরদিন ১৮ এপ্রিল দুপুরে চুয়াডাঙ্গা থেকে এসে পাক সেনারা মেহেরপুর সদরের আমঝুপি গ্রামে নির্বিচারে হামলা চালায়। এক সপ্তাহের মধ্যেই মেহেরপুর সরকারি কলেজ, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল—এই তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।

তিনি আরও জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত গেরিলা হামলায় দিশেহারা পাক সেনারা যখন পিছু হটতে শুরু করে, তখন তারা মেহেরপুর ত্যাগের সময় দিনদত্ত ব্রিজ, খলিশাকুন্ডি ও তেরাইল ব্রিজ এবং বৈদ্যুতিক স্থাপনাসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করে যায়। তবুও আমরা হার মানিনি, স্মৃতিভারী কণ্ঠে বলেন আব্দুল মজিদ পাতান।
পাঁচ ডিসেম্বরের রাত থেকেই পাক সেনারা গোপনে সরে যেতে থাকে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করলে অবরুদ্ধ সাধারণ মানুষ বিজয়ের উল্লাসে তাদের স্বাগত জানায়। লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে মেহেরপুর ঘোষণা করে মুক্তি।

সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সামসুল আলম সোনা জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলার ভাটপাড়া থেকে অদূরে সাহারবাটি টেঁপুখালি, হিন্দা, লক্ষ্মীনারায়ণপুর, ধলা, গাড়াবাড়িয়া, জোড়পুকুরিয়া, ভোমরদহ, ধর্মচাকীসহ বহু গ্রামে নির্বিচারে গণহত্যা চালায় পাক বাহিনী। সেই বেদনার ক্ষত আজও বয়ে বেড়ায় পরিবারগুলো। তবুও ৬ ডিসেম্বরের সকাল আমাদের জন্য নতুন সূর্যের আলো নিয়ে আসে,” বলেন তিনি। সেদিন পুরো মেহেরপুর লাল-সবুজ পতাকায় রাঙা হয়ে উঠেছিল; মনে হচ্ছিল বাংলা আবার নতুন করে জন্ম নিচ্ছে।

ঐতিহাসিক এই দিনটিকে শ্রদ্ধা আর মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করতে মেহেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল আজ শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
সকালে সাড়ে ৮টায় মেহেরপুর সরকারি কলেজ মোড়ের কেন্দ্রীয় শহীদ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে জেলার বিভিন্ন সংগঠন, প্রশাসন ও সাধারণ মানুষ সেখানে সমবেত হন।

এরপর সকাল সাড়ে ৮টায় কলেজ মোড় থেকে জেলা শিল্পকলা একাডেমি পর্যন্ত একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের হয়। লাল-সবুজ পতাকা, দেশপ্রেমের স্লোগান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সাজানো র‌্যালিটি পুরো শহরের পরিবেশকে উজ্জীবিত করে।

সকাল ৯টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। মুক্তিযুদ্ধে মেহেরপুরের ভূমিকা, যুদ্ধের বিভিন্ন অধ্যায়, শহীদের ত্যাগ এবং নতুন প্রজন্মের করণীয় নিয়ে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।

বক্তারা বলেন, মেহেরপুর শুধু প্রথম রাজধানীই নয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। এই জেলার মানুষ প্রথম থেকেই স্বাধীনতার পক্ষে প্রাণপণ লড়াই করেছে। আজকের প্রজন্মের কাছে মুক্ত দিবসের বার্তা—স্বাধীনতা রক্ষায় সততা, দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধে অটল থাকা।

পুরো জেলায় দিনব্যাপী বিশেষ প্রার্থনা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। স্বাধীনতার স্মৃতি লালন এবং শহীদদের আত্মত্যাগকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে অনেক পরিবার নিজ উদ্যোগেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।

আজ ৬ ডিসেম্বর—মেহেরপুরের মুক্তির দিন। যে দিন মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত, ঘাম আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে জন্ম নেয় স্বাধীন দেশের প্রথম মুক্ত জেলা। ইতিহাসের সেই গৌরবমাখা দিনটি আজও মেহেরপুরবাসীর অন্তরে প্রজ্বলিত করে দেশপ্রেমের মশাল।



রিলেটেড পোস্ট

মতামত দিন


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.